আজ শুক্রবার, ১২ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৭শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

সকলের ভালবাসা আমার জীবনের পরম সম্পদ

এটিএম কামাল

দেশ থেকে কেউ ফোন করলে জানতে চাইনা কেমন আছেন? আজকাল কেমন আছে জানার চেয়ে এখনো যে সে বেঁচে আছে সেটাই আল্লাহর কাছে হাজারো শুকরিয়া আদায় করি। ০৭ মে আমার ৬২ তম জন্মদিন গেল , ফোনে, ক্ষুদে বার্তায় , ফেফবুক, ইমু, ভাইবার, সিগন্যাল, হোয়াট’স আপ সহ নানা যোগাযোগ মাধ্যমে শুভেচ্ছা, শুভ কামনা ও ভালোবসার বন্যায় ভেসেছি। এবারের জন্মদিনে আমি আমার জীবনের সর্বোচ্চ পুরস্কারগুলো পেয়েছি, করোনা আক্রান্ত আমার ভাগ্নী ও ভাগ্নীর স্বামী খোকন-লীজার কুয়েত মৈত্রী থেকে ফিরে আসা, এর আগে আমার বড় মেয়ে শমির আর নাতিন জারার সুস্থ হয়ে উঠা।

মার্চের ১০ তারিখে এমেরিকা যখন পৌছলাম তখনো শমির কলেজে ক্লাশ চলছে। করোনার কারনে যখন কলেজ বন্ধ হয়ে গেল , তখনো সে বিশেষ প্রয়োজনে নোট নিতে কলেজের লাইব্রেরীতে যায়, সেখানকার কমন কম্পিউটার ব্যাবহার করে। এটা গ্রেজুয়েশেনের শেষ সেমিষ্টার। সম্পূর্ন লক ডাউনের পরে কলেজে যাওয়া বন্ধ হলো, কিন্তু বাসায় অন লাইনে পরীক্ষা চলছে। এর মধ্যে সে অসুস্থ হয়ে গেল, জ্বর, খুশ খুশে কাশি, গলা ব্যাথা। এখন এখানে সামার চলছে, তখন মাত্র শীত শেষ হলো, সিজন চেঞ্জের সময় , আমি আর কেয়া বললাম, এটা নিয়ে চিন্তার কারন নেই, সামান্য জ্বর, ঠান্ডা, সিজন চেঞ্জের কারনে হয়েছে , ২/৩ দিনেই ঠিক হয়ে যাবে।

এমনি করে প্রায় সপ্তাহ গেল, ঔষধের মধ্যে শুধু অফারষ প্যারাসিটামল জাতীয় সুগার কোটেট ট্যাবলেট। লেবু চা, আদা চা, সবরকমের গরম মসলা ,রসুন সরিষার তেল , কালি জিরা, লেবু মিশিয়ে সিদ্ধ করে চা আর ভাপ। ভিনিগার আর লবনের গার্গল, কোনটাই বাদ দেইনি , ওকে খাওয়াচ্ছি, আমরাও খাচ্ছি , নিচ্ছি। এর পরেও তার শরীরটা আরো খারাপ হলো, ডাক্তারের এপয়েনমেন্ট নেওয়া হলো। আগে ভিডিও কলে রোগীর সাথে কথা বলবে, ডাক্তার দীর্ঘ সময় শমির সাথে কথা বলে ওর সকল উপসর্গ জেনে, তাকে অফারষ এর পাশাপাশি, এন্টি হিস্টামিন জাতীয় টেবলেট, আরো ৭ দিন খেতে বললো। তারপরেও যদি না ভালো হয় তাহলে অুরঃযৎড়সুপরহ ৫ দিনের কোর্স দিয়ে দিল।

এন্টি হিস্টামিন খাওয়া শেষ হলো, তারপরেও সুস্থবোধ না করাতে এন্টিবায়োটিকও ৫ দিনের কোর্স শেষ হলো। এরপর শুরু হলো নতুন উপসর্গ ডাইরিয়া, বুক ব্যাথা। শমি অন লাইনে ক্লাস করছে, পরীক্ষা দিচ্ছে। কবির এখানকার সরকারি রেলওয়েতে কাজ করে, তার অফিস বন্ধ হয়নি। প্রতিদিনই বিকাল ৩ টা থেকে গভীর রাত অবধি অফিস করতে হয়। এদিকে আমি আর কেয়া রাতদিন পাশেই পালা করে কাটাই যেন সমি একাকিত্বে না ভোগে, দফায় দফায় চা কফি বানায়ে খাওয়াই, আর কেয়া তার পছন্দ অনুযায়ী খাবার বানায়ে জোর করে খাওয়ায়, পানির বোতল নিয়ে পাশে বসেই থাকে , পাঁচ মিনিট পর পর পানি খাওয়ার জন্য তাগাদা দেয়। এভাবেই যখন কাটছে আমাদের দিনরাত্রি। একদিন হঠাৎ কবির হঠাৎ অফিস থেকে বাসায় চলে এলো, তখন খুব সম্ভবত বিকাল ৪টা বাজে, আমিতো অবাক, শমি বললো সে ফোন করেছে আসতে, তার নাকি একটু শ্বাস কষ্ট হচ্ছে ইমারজেন্সীতে যেতে হবে।

শমি হাসপাতালে চলে গেল, কেয়ার মুখ থমথমে।আমি নিজেকে বড় অসহায় বোধ করছিলাম, মনে মনে শধু একটি কথাই বললাম, আমার জীবনের বিনিময়ে হলেও আল্লাহ আমার সন্তানকে ফিরিয়ে দাও। রাতে শমি হাসপাতাল থেকে ফিরে এলো, শুনলাম, এক্সরে সহ বিভীন্ন ফিজিকেল টেষ্ট করে সে ব্রংঙ্কাইটিসে আক্রান্ত হয়েছিলো বলে সেখানকার চিকিৎসকরা বলেছে। যেহেতু ৩ সপ্তাহ অতিক্রম হয়েছে এখন আর ভয়ের কারন নেই। শ্বাস কষ্টের জন্য ইনহেলার দেয়া হলো। ধীরে ধীরে শমি সুস্থ হলো। এরপর জারা অসুস্থ হলো, আল্লাহর রহমতে জারামনি ২/৩ দিনেই সুস্থ হয়ে গেল। এবার আমার পালা, আমিও প্রায় দুই সপ্তাহ লড়াই করলাম। এরিমাঝে খোকন আক্রান্ত হলো, এর ১০দিন পর লিজাও হাসপাতালে গেল। দেশ বিদেশ মিলিয়ে আমাদের পুরো পরিবারটাই তখন একটা মহা বিপর্যয়ের মধ্যে। তবে সাহস হারাইনি, ভেবেছি নিউইয়র্কের সেই পরিবারগুলোর কথা, যারা স্বজনদের লাশ নিয়ে অপেক্ষা করছে ঋঁহবৎধষ উবঢ়ঃ. ( পৌর সভার লাশ দাফনকারি বিভাগ) কখন আসবে, দাফন করতে লাশ নিয়ে যাবার জন্য।

০৭ মে শমি শেষ পরীক্ষা দিলো। লকডাউনের কারনে শেষ পরীক্ষা গুলো অন লাইনেই হলো। অষযধসফঁষরষষধয সে শারীরিক অসুস্থ্তা নিয়ে যে অমানুষিক পরিশ্রম করছে আল্লাহ তাঁর পুরস্কার দিয়েছে। অ এৎধফব নিয়ে আল্লাহর রহমতে ধংংড়পরধঃব এৎধফঁধঃরড়হ কমপ্লিট করলো আমাদের শমি। আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের দয়ায় কুয়েত মৈত্রী হাসপাতাল হতে সুস্থ হয়ে খোকন লিজাও বাসায় ফিরে এলো। সব সময় শুধু ভাবি যদি আমাদের কারোর কিছু হতো তাহলে আম্মাকে কি করে বাঁচাতাম !

সবার দোয়া আর ভালোবসাতেই বেঁচে আছি, সবার ভালোবাসা নিয়েই যেতে চাই। আমার মা, বাবা, মুরুব্বীয়ান, স্ত্রী, ভাই-বোন, সন্তান, আত্মীয়স্বজন, শুভানুধ্যায়ি, শুভকাংঙ্খি, বন্ধু , রাজনৈতিক সহকর্মী ও বিভীন্ন শ্রেনীপেশা, বর্ন ধর্ম, দল-মত নির্বিশেষে আমার জীবন চলার পথের সুখে-দুঃখে, দূর্যোগ-দূর্ভোগে সকল সময়ে সবার যে ভালোবাসা আমি পেয়েছি, সেটাই আমার জীবনের পরম সম্পদ। এই ভালোবাসা ও আস্থাই আমার একমাত্র প্রানশক্তি, আমার জীবন চলার পথের দিশা। আমার বাবা মাকে আমি আজীবন জ্বালিয়েছি, আমার স্ত্রী সারাটা জীবন আমার জন্য কষ্ট করছে। আসলে আমার মত ভাগ্য খুব কম মানুষেরই হয়, বাবা মা, স্ত্রী, আত্মীয় স্বজন, সন্তান, ভাই-বোন, বন্ধু, সহকর্মী, শুভানুধ্যায়ী সকলের অফুরন্ত ভালোবাসাতেই শিক্ত আমি, কিন্তু করোর জন্যই কিছুই করতে পারিনি। সবাইকেই সারাটা জীবন শুধু বিরক্ত করেছি, বিব্রত করেছি, ভালোবাসার সূযোগ নিয়ে নানা অন্যায় আবদার করেছি।

দোষে গুনে একজন সামান্য মানুষ আমি। জীবনে জান্তে-অজান্তে অনেক ভূল-ভ্রান্তি করেছি। আমার কোন আচরন ও ব্যাবহারে কেউ যদি কষ্ট পেয়ে থাকেন, তারজন্য ক্ষমাপ্রার্থী। জানিনা আর কতদিন আছি এই পৃথিবীতে। আজ এই ৬২ বছরে এসে জীবনের খাতায় শুধুই প্রাপ্তি, আর প্রাপ্তি। কারোর জন্যইতো কিছুই করতে পারলাম না। না দেশ, না সমাজ ও পরিবার। এই অতৃপ্তি নিয়েই হয়তো একদিন চলে যেতে হবে। অনন্ত যাত্রায়। ভালো থাকুন সবাই। করোনার কালো অন্ধকার কেটে যাক, নিরাপদ হউক আমাদের ভালবাসার পৃথিবী। একটি নতুন ভোরের প্রত্যাশায়।